মেহেরগড় সভ্যতার নিদর্শন সম্পর্কে আলোচনা করো Discuss the patterns of civilization of Mehergarh?কৃষিকাজ ও পশুপালন,সাংস্কৃতিক নিদর্শন,ব্যাপ্তি বা বিস্তার, নবম শ্রেণী

মেহেরগড় সভ্যতার নিদর্শন সম্পর্কে আলোচনা করো(Discuss the patterns of civilization of Mehergarh?

আবিষ্কারঃ-

১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে নব্যপ্রস্তর যুগীয় মেহেরগড় সভ্যতার আবিষ্কার হয়। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দেআগস্টে ‘সায়েন্টিফিক আমেরিকান পত্রিকায় এই সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ সম্পর্কিতপ্রথম গবেষণানিবন্ধ প্রকাশ হয়। রেমন্ড অলচিন (R. Allchin) ও ব্রিজেট (Bridget) দ্য রাইজ অব সিভিলাইজেশন ইন ইন্ডিয়াঅ্যান্ড পাকিস্তান’ (১৯৯৬) গ্রন্থে মেহেরগড় নিয়ে আলােচনাকালে বলেছেন কৃষিজীবীদের প্রথম আবির্ভাব ঘটেছিল বেলুচিস্তানে। ফরাসি  প্রত্নতাত্ত্বিক জেন ফ্রাঁসােয়া জারিজ (Jarrige) ও মার্কিন প্রত্নতাত্ত্বিক রিচার্ড মিডৌ (Meadow) মেহেরগড় সভ্যতা আবিষ্কার করেন।          

       
                         

বিশ্বের এই প্রাচীনতম সভ্যতার উৎসস্থল উত্তর-পশ্চিম ভারতে।‘এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা’তেও আর্য শব্দটিকে গুণবাচক বলে স্বীকার করে মেহেরগড় সভ্যতার সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা পরিষ্কার বলা আছে। মার্কিন ভারততত্ত্ববিদ ডেভিড ফ্রলে (Froley), মেহেরগড়, হরপ্পা ও বৈদিক সভ্যতাকে “সিন্ধুসরস্বতী সভ্যতা”আখ্যা দিয়ে এক অবিভাজ্য সভ্যতার বিভিন্ন পর্ব বলে মন্তব্য করেছেন।

কৃষিকাজ ও পশুপালনঃ-

বেলুচিস্তানের কাচ্চি সমভূমিতে মেহেরগড় সভ্যতার আবিষ্কারএরকমই এক রহস্যময় ঐতিহাসিক ঘটনা। বেলুচিস্তানের ঝােব নদী থেকে পশ্চিম ভারতের সিন্ধু নদী পর্যন্ত বিশাল এলাকা জুড়ে মেহেরগড় সভ্যতা গড়ে ওঠে বলে পণ্ডিতদের ধারণা। এর কারণ—

(i) মৌসুমি বায়ু সভ্যতা গড়ে ওঠার উপযােগী হয়ে অবস্থান এখানে আবির্ভূত হয়,

(ii) উর্বর ঝােব নদীর উপত্যকা,

(iii) জলবৃষ্টির প্রাচুর্য,

(iv) উন্নত নদীবাঁধ ও সেচব্যবস্থার জন্য এলাকাটি শস্যশ্যামল হয়ে ওঠে।

মেহেরগড় অঞ্চলের মানুষ কৃষি ও মেহেরগড় সভ্যতা পশুপালনকে প্রধান পেশারূপে নিয়েছিল। নব্যপ্রস্তর যুগের সংস্কৃতি তাই অনেকটাই কৃষিকেন্দ্রিক। ইন্দো-পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমে কোয়েটা, ঝােব্‌ (Zob) ও লােরালাই, নদীর উপত্যকা অঞ্চলের উন্নত কৃষিব্যবস্থা মেহেরগড় সভ্যতার সমৃদ্ধির মূল কারণ। এখানকার মূল কেন্দ্রগুলি হল কিলে গুল মহম্মদ (Kile Gul Muhammad), রানাঘুনডাই (Rana Ghundai), গুমলা মহেনজোদারাে (Gumla), আনজিরা (Anjira), মুন্ডিগাক (Mundigak) ও মেহেরগড় (Mehrgarh)। মেহেরগড় সভ্যতাটি কাচ্চি সমভূমি আমরি (Kacchi) তে অবস্থিত।* মেহেরগড়সভ্যতার আবিষ্কর্তা জেন ফ্রাঁসােয়া জারিজের ধলভিরা নাগওয়াদা হিসাবমতাে এই সভ্যতা প্রায় ৫০০ একর বা পনেরােশাে বিঘা জমির উপর গড়ে উঠেছিল।

সাংস্কৃতিক নিদর্শনঃ-

নব্যপ্রস্তর যুগের এই উন্নত গ্রামকেন্দ্রিক সভ্যতার সাংস্কৃতিক নিদর্শন মেলে বেলুচিস্তানের কাচ্চি সমভূমির প্রখ্যাত বােলান গিরিপথের নিম্নে প্রবাহিত বােলান নদীর তীরে কোয়েটা শহর থেকে প্রায় ১৫০ কিলােমিটার দূরে সিন্ধুনদীর অববাহিকার পশ্চিম তটে। মেহেরগড় গ্রামে প্রথম এই সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কার করেন ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিকরা। ‘রেডিয়াে কার্বন-১৪’*১ পদ্ধতির সাহায্যে জানা গেছে মেহেরগড়ে বসতিস্থাপন (habitation) ঘটে সাতটি স্তরে। এর মধ্যে প্রথম ও সর্বপ্রাচীন পর্যায়ে ৭০০০ খ্রিঃ পূঃ থেকে ৫০০০ খ্রিঃ পূর্বাব্দে বসতি গড়ে ওঠে বােলান নদীর তীরে M.R-৩ (এর A ও B উপ-পর্যায় আছে) নামাভূত স্থানে। সমগ্র অঞ্চল জুড়ে রয়েছে একহাজার গজ ব্যাসবিশিষ্ট ৬টি টিলা বা ঢিবি। এই পর্যায়ে রােদে শুকানাে ইট, কাদামাটি বা পাথর দিয়ে তৈরি জানালাবিহীন ছােটো-ছােটো চতুষ্কোণ ঘরে মানুষ বাস করত। আগুন জ্বালিয়ে ঘরগুলি গরম রাখার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা ছিল। এই স্তরে মানুষ কৃষিকাজ, পশুপালন, পশুশিকার করত ও মৃতদেহ গর্ত খুঁড়ে সােজাসুজি, কোঁকড়ানাে বা কাত করে বিভিন্ন ব্যবহৃত সামগ্রীর সাথে সমাধি দেওয়া হত। 


ব্যাপ্তি বা বিস্তারঃ-

বসতি স্থাপনের দ্বিতীয় পর্যায়ে (৫০০০ খ্রিঃ পূঃ—৪০০০ খ্রিঃ পূঃ) পরিণত কৃষির জন্য নদীবাঁধ নির্মাণ।জলসেচের ব্যবস্থা, কাঠ বা হাড়ের হাতলযুক্ত কাস্তের ব্যবহার শিল্পক্ষেত্রে ড. দিলীপকুমার চক্রবর্তীর মতে তামা গলানাের পদ্ধতি আবিষ্কার মেহেরগড় সভ্যতার উন্নতির এক নতুন সােপান তৈরি করেছিল। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইরফান হাবিব বলেন, “দ্বিতীয় পর্যায়ে পােড়া তুলাের বীজই সুতিবস্ত্রের আদিম উৎস সম্পর্কে আমাদের অবগত করে।” এইসময় পশ্চিম এশিয়া থেকে গম, যব ও বার্লি বীজ আমদানি হওয়ায় কৃষিবিপ্লবের নবপর্যায় শুরু হয় এবং মেসােপটেমিয়া - থেকে কুমােরের ঘুরন্ত চাক আনার ফলে সুদৃশ্য ও কারুকার্যময় মৃৎপাত্র তথা মৃৎশিল্পে নতুন মুনশিয়ানার অভিষেক ঘটে। নগরায়ণের তৃতীয় পর্বে (৪০০০ খ্রিঃ পূঃ—৩২০০ খ্রিঃ পূঃ) তাম্রশিল্প ও লাল, হলুদ ও কালাে রং-এর নকশাযুক্ত বহু মৃৎপাত্র ঝােং, কোয়েটা ও মুন্ডিগাক থেকে পাওয়া গেছে। নগরায়ণের চতুর্থ থেকে সপ্তম পর্যায়ে পাওয়া যায় বহু বর্ণময় মৃৎপাত্র, শস্য রাখার বিশালাকার মাটির জালা, পােড়ামাটির নারীমূর্তি, বড়াে মাপের ঘর ইত্যাদি।

           মৃৎশিল্পের যুগের আগে মেহেরগড়ে বিচ্ছিন্ন বর্গাকার বা আয়তাকার মাটির তৈরি ইট দিয়ে বাড়িঘর তৈরি হয়েছিল। দুটি বাড়ির মাঝে গলিপথ ছিল। বাড়িগুলি চার বা তার বেশি প্রকোষ্ঠে ভাগ করা ছিল, যার কিছু কিছু আবার গুদামঘররূপে ব্যবহার করা হত।* বাড়ি তৈরি করতে রােদে পােড়ানাে ইটই ব্যবহৃত হত প্রথম দিকে।

বয়সঃ-

ড. বি. এন. মুখার্জির মতে মেহেরগড় সভ্যতা আনুমানিক ৭০০০-৬০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের প্রাচীন সভ্যতা।সাতটি পর্যায়ে এর নগরায়ণ প্রক্রিয়া চলেছিল। তবে নগরায়ণের পরিণত রূপটি দেখা যায় ৩২০০-২৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। ডায়ােডারাস ও প্লিনির লেখা থেকে জানা যায় ৬৭৭৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এবং স্ট্যাবাের মতে ৬৩২৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারতে নগরায়ণ হতে পারে, যার উৎস মেহেরগড়।

   পণ্ডিত জারিজা, মিডৌ, জে. ই. কিচনার, জি. আর. হান্টার, এস. আর রাও, সুভাষ ফাক,বল্কবিহারী চক্রবর্তী প্রমুখ মনে করেন, মেহেরগড় সভ্যতার পরিবর্তিত রূপ হল হরপ্পা-মহেনজোদারাে ও লােথাল সভ্যতা। তাই সিন্ধু সভ্যতার বয়স এখন (মেহেরগড় + হরপ্পা হয়ে) বেড়ে দাঁড়াল অন্তত ৮,৫০০ বছর। শুরুতে হাতের তৈরি ও পরে কমােরের চাকার সাহায্যে মাটির পাত্রগুলি  হয়েছিল। আগুনে পােড়ানাে মৎপাত্ৰগলিতে ‘টেরাকোটা শিল্পের’ নিদর্শন ছিল।

* প্রথম দিকে মানুষ ‘খাদ্যসংগ্রহকারী’ হলেও পরে ‘খাদ্য-উৎপাদকে’ পরিণাম হয়েছিল। গম, যব, কুল,খেজর ও বার্লি প্রধান খাদ্য ছিল। গৃহপালিত তালিকায় ককব। ভেড়া, ছাগল, শূকর, হাতি, হরিণ,নীলগাই,ষাঁড়, মােষ ও গােরুর হাড় আবিষ্কৃত হয়েছে। তবে এগুলি বুনাে না পােষা তা সঠিকভাবে বয়সএখন (মেহেরগড + হরপ্পা হয়ে) বেড়ে দাঁড়ায় অন্তত ৮,৫০০ বছর।

অন্যান্য নিদর্শনঃ-

খ্রিস্টপূর্ব ছয় মিলিয়ান অকে হাতের তৈরি মৃৎপাত্র ও হাড়ের নানা জিনিসপত্র তারা জীবিকার প্রয়ােজনেতৈরি করত; বহু কবর থেকে আবিষ্কৃত নানা জিনিসের মধ্যে হার, কানপাশা,জাঁতা হামানদিস্তা, শাঁখের বালা, বৈদূৰ্য্যমণি ও নীলকান্তমণির পুঁতির মালা ইত্যাদি অন্যতম।পরবর্তী ৫০০ বছরে মানুষ কারিগরি উন্নতি ও টেরাকোটা শিল্পের পারদর্শিতা দাবি করে।পাথর ও ধাতুর তৈরি নানা অলংকার ও বাসনপত্র সভ্যতাকে একধাপ এগিয়ে দেয়। এছাড়া তামার ছুরি ও বঁড়শি, হাড়ের সুচ, তুরপুন, টার্কোয়াজ পাথরের কুড়ুল,ঝিনুক ও পাথরের লকেট, হাড়ের আংটি ও হাতিয়ার, উনুন, পাথরের শিলনােড়া ইত্যাদির ব্যবহার জানত। ঐতিহাসিক সেরিন রত্নাগারের মতে সুতিবয়ন বিদ্যা সম্ভবত তাদের অজানা ছিল।

পতনঃ-

মেহেরগড়ের মানুষ ইরান, আফগানিস্তান ও তুর্কমেনিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছিল। আনুমানিক ২৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই সভ্যতা মানবশূন্য হয়ে পড়ে। এর কারণ--

(ক) বহিঃশত্রুর আক্রমণ, 

(খ) প্রাকৃতিক বিপর্যয় তথা জলবাইয়ুর পরিবর্তন ও 

(গ) সিন্ধু সভ্যতায় লীন হয়ে গিয়েছিল। তবে ঐতিহাসিকরা একমত যে হরপ্পা সভ্যতা মেহেরগড় সভ্যতার কাছে চিরঋণী।

মন্তব্যঃ-

সবদিক বিবেচনা করে বলা যায়, নব্যপ্রস্তর যুগে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম সভ্যতার - বিকাশ ঘটে সিন্ধু নদীর পশ্চিমে। *এখানকার মেহেরগড়ে খ্রিস্টপূর্ব ৮০০০ অব্দে নব্যপ্রস্তর যুগের সংস্কৃতির বিকাশ ও বিস্তার ত্বরান্বিত হয়।




Post a Comment

0 Comments